ঢাকা, ৫ আগস্ট ২০২৫:
মাত্র একটি রায়ের প্রতিবাদ থেকে শুরু হয়েছিল, শেষটা হলো এক স্বৈরশাসকের পতনের মধ্য দিয়ে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন রূপ নেয় দেশের ইতিহাসের অন্যতম বড় গণঅভ্যুত্থানে। এ অভ্যুত্থানেই ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের একটি রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল হওয়ার পর থেকেই বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এই আন্দোলন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র। পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর পর ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে সারাদেশ। সেই উত্তাল সময়ই ইতিহাসে পরিচিতি পায় ‘৩৬ জুলাই’ নামে।
📌 জুলাই আন্দোলনের শুরু: একটি রায়ের প্রতিবাদ
২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর সরকার তা বাতিল করলেও ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট এক রায়ে কোটা পুনর্বহাল করলে ফের আন্দোলনের সূচনা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা শুরু করে মিছিল-সমাবেশ।
১৪ জুলাই শেখ হাসিনার একটি 'রাজাকার' মন্তব্যে ক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। সেই রাতে ঢাবির হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা শ্লোগান দেন—"তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার"। দেশজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এই উত্তাল আন্দোলন।
⚠️ ছাত্রলীগের হামলা, পুলিশের গুলি, মৃত্যুর মিছিল
১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মাঠে নামার ঘোষণা দেন। শুরু হয় নির্যাতন, হামলা, গুলি। ১৬ জুলাই নিহত হন আবু সাঈদ, ওয়াসিমসহ ছয়জন শিক্ষার্থী।
তখন থেকেই আন্দোলন রূপ নেয় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’-এ। ঘোষিত হয় ৯ দফা দাবি। সরকারের দমন-পীড়নের জবাবে সারা দেশের মানুষ রাজপথে নামে। শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, সেনা কর্মকর্তারাও একাত্মতা প্রকাশ করেন।
🚫 গণগ্রেপ্তার ও জোরপূর্বক ভিডিও বার্তা
আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছয় শিক্ষার্থীকে (নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুম) তুলে নিয়ে গিয়ে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়। সেখান থেকে জোরপূর্বক আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও প্রচার করা হয়।
কিন্তু তাতেও আন্দোলন থামেনি, বরং আরও বেগবান হয়। ১ আগস্ট স্মরণে পালন করা হয় 'Remembering Our Heroes' দিবস।
🏛️ অসহযোগ আন্দোলন ও 'মার্চ টু ঢাকা'
৩ আগস্ট শেখ হাসিনা আলোচনার প্রস্তাব দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনকারীরা। ৪ আগস্ট দেশজুড়ে সংঘর্ষে নিহত হন অন্তত ৯৩ জন। একদিন পর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা ঢাকামুখী হয় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে। সেদিনও শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হয় হত্যাযজ্ঞ।
শেষ পর্যন্ত ব্যাপক চাপের মুখে পদত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা—এক অনন্য ইতিহাসের জন্ম হয়।
🗣️ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখে '৩৬ জুলাই'
ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম বলেন, “দেশজুড়ে দীর্ঘদিনের অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে এক মানসিক ঐক্য তৈরি হয়েছিল। কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে তা বিস্ফোরিত হয়েছে।”
আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের জানান, “এই আন্দোলন ছিল অবশ্যম্ভাবী। যে স্বৈরাচার শিক্ষার্থীদের বুকে গুলি চালায়, তার পতন অনিবার্য ছিল।”
মন্তব্য করার জন্য লগইন করুন!